-নিশি. .নিশি. .একবার বাইরে আয়।দেখ কী সুন্দর চাঁদ।ছাদে গেলাম।বাবা দাঁড়িয়ে আছেন ছাদের রেলিং এর পাশে।চাঁদটা সত্যি বেশ সুন্দর।জ্যোছনা রাত আজ।ওবাড়িতে থাকলে অর্ণব আর আমি ওদের ছাদে চিলেকোঠার ঘরটায় থেকে জ্যোছনা দেখেই রাত পার করে দিতাম।বিয়ের পর কত হয়েছে এমন!গান শোনাবার জন্য জিদ ধরে বসত সে. .এখন হয়ত তার ওই সময়টাও হবে না.ব্যস্ততা ফেলে চাঁদ দেখার অবসর তার হবেই না. .বাবার সামনে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম -নিশি মা!বল বাবা।তোর কী মন খারাপ?নাতো বাবা।কেন?না,মানে কাল হঠাৎ একা কিছু নাজানিয়ে চলে এলি। জামাইয়ের সাথে কোন ঝামেলা.কেন বাবা?আমার ইচ্ছে হলে আমি বুঝি এবাড়ি আসতে পারি না?কিছু হয়নি বাবা।আমি বেশ আছি।তোমাকে,মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তো.নিশ্চয়ই আসবি।তুই এসেছিস বলেই তো তোর মায়ের সাথে আমার ঝগড়াটা মিটমাট হল।হাহাহা।শোন মামণি,সংসার করতে গেলে এসব মনোমালিন্য হয়ই।তা বলে কী কেউ সংসার করে না?এসব কোন বিষয় না।এসেছিস খুব ভাল করেছিস।তোর মনটাও ভাল থাকবে।তবে এখন একটা আর্জি রাখ তো বাবার।আর্জি?কী ??'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে' গানটা গেয়ে শোনা।কতদিন গান শোনা হয় না তোর।বাবার জোরাজুরিতে গাইলাম গানটা।বাবা খুব রবীন্দ্রসংগীত ভালবাসেন।অর্ণবও তাই।কলেজে থাকতে প্রায়ই বলতো,'ভাবনা কাহারে বলে' গানটা গেয়ে শোনাতে.বাবার ধারণা মিথ্যে না।প্রায় ঝগড়া করেই চলে এলাম এবাড়িতে।অর্ণবটা কেমন পাল্টে গেছে।একসাথেই মেডিকেলে পড়তাম।থার্ড ইয়ার থেকে প্রেম।আমাকে রাজি করাবার জন্য কী পাগলামিটাই না করল সে।হোস্টেলের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত একবার আমাকে দেখবে বলে,পড়ায় ফাঁকি দিত,পরীক্ষায় বসতে চাইত না।কবিতা আর গানে দুজনেরই রুচি একই ছিল।এসব নিয়ে কত আড্ডা,কত কবিতা একসাথে করতাম,কত গান গেয়ে শোনাতাম ওকে.ফাইনাল পরীক্ষার সময় দিনরাত লাইব্রেরীতে বসে ওকে পড়াতাম।পাশ করার পর বাড়িতে ওর কথা বলার পর প্রথম প্রথম কেউ রাজি হলেন না।কারণ তখন আমরা মাত্র ইন্টার্নশিপ শেষ করেছি।ওর চাকরী নেই। নিজেদের পড়ার খরচই চালাতে হিমসিম খাব,সে আমার দায়িত্ব কী করে নেবে!ভাইয়াও খুব রাগারাগি
করছিল।যেদিন বাবা বললেন,তুই তাহলে একটা কথা বলে আশ্বস্ত কর
আমাকে।তুই কী বিশ্বাস করিস,ছেলেটার সাথে তুই ভাল থাকবি?আমি এক মুহূর্তও না ভেবে বলেছিলাম,হ্যাঁ বাবা,তোমরা দেখো,আমি ওর সাথে ভাল থাকব বাবা।সে আমাকে
অনেক ভালবাসে।বাবা তখনই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।অর্ণবদের বাসায়ও কোন সমস্যা ছিল না।কিন্তু বিয়ের মাস খানেক পরই অর্ণবকে আমার খুব অচেনা লাগতে থাকে।সেই রোজকার মত দিন কাটে আমাদের।নতুন কোর্সে ঢুকে সেও ব্যস্ত থাকে।আমিও।তবু ঘরে ফিরে ভালমত কথাই হয় না আমাদের।আমিও তো টায়ার্ড থাকি।তাই বলে একদম কথাবার্তা বলা যাবে না?এসেই কী ঘুম দেয় সে!পরদিন সকালে আবার সেই রুটিন।কতদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না,চা খেতে খেতে আড্ডা দেয়া হয় না,ছাদে গিয়ে একের পর এক গান শোনা হয় না. .কতদিন.অর্ণব,তুমি কত বদলে গেছ!একবছর হয়ে গেছে বিয়ের।প্রায়ই এবাড়ি আসা হয়।অর্ণবই এতদিন নিয়ে আসত।আর গতকাল সকালে ওকে বললাম,ভাল লাগছে না।একবার বাবা-মা কে দেখে আসতে ইচ্ছে করছে।তুমি কী যাবে আমার সাথে?কবে?আজ?না না।আজ কী করে সম্ভব?আজকে একটা সেমিনার এটেন্ড করতে হবে খুব ইম্পরট্যান্ট।তোমাকে সেদিন বললাম না.হুম আচ্ছা।আমি একাই চলে যাব।ব্যস।সে বেরিয়ে গেল।আগে কোথাও একা ছাড়ত না। আর এখন তার আমার সাথে থাকার ফুরসতই নেই।ভীষণ রাগ হল আমার।একটা ফোনও করল না।যাব না আর।এখানেই থাকব।ঘরে ফিরে দেখি একটা মেসেজ,"চাঁদটা দেখেছ,নিশি?কী সুন্দর!তোমার গান শুনতে ইচ্ছে করছে খুব।কখন আসবে?তাড়াতাড়ি চলে আস।ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।"রাগে অভিমানে চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে!যাব না আমি তোমার কাছে।তুমি থাক তোমার ব্যস্ততা নিয়ে।ইশ!এতক্ষণে মনে পড়ল তোমার,না?যাব না আমি।কলিং বেলের আওয়াজ হচ্ছিল।বাবা গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।ঘরে বসে রইলাম।বের হয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে না।হবে কেউ একজন।একা বসে বসে অর্ণবের মেসেজটার দিকে তাকিয়ে আছি।একবার তো উঠে গিয়ে দেখলেও না কে এল!অর্ণবের গলা শুনে চমকে ফিরলাম।একী তুমি এতরাতে!!আমার বউয়ের কাছে আমি যখন ইচ্ছে চলে আসব।তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে নাকি?নাহ।আমায় যেন খুব জিজ্ঞেস করা হয় সবকিছুতে?কোন দরকার থাকলে ফোন করলেই পারতে।আসার কী দরকার ছিল?একটা দরকার যে ছিল.কী?হাতের ব্যাগ থেকে দুই জোড়া মোজা বের করল সে।দেখো তো মাপটা ঠিক আছে কি না?মেয়ে হলে এই পিংক কালারেরটা।আর ছেলে হলে এই ব্লু কালারেরটা।ঠিক আছে?আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।বুঝতে সময় লাগছে আসলে কী হচ্ছে।সে এসে আমার কপালে চুমু খেয়ে
আমাকে বুকে টেনে নিল।তারপর বলল,সকালে প্রেগিন্যান্সি টেস্টের জন্যে গিয়েছিলে না?রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।ভাবলাম ওর এই পৃথিবীতে আসতে আসতে খুব শীত পড়ে যাবে।তাই মোজা নিয়ে আসলাম।ঠিক করি নি?আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম।এত সুখ আমার কপালে ছিল!!সত্যি আমার মধ্যে অন্য একটা প্রাণ!নিষ্পাপ একটা শিশু আমাকে 'মা' বলে ডাকবে সত্যি!আমি 'মা' হব!মাঝে মাঝে বোধ হয় বদলে যেতে হয়।পুরোনো সুখগুলো নতুনের সাথে বাঁধতে গেলে একটু হয়ত পিছিয়ে যেতে হয়।আর ভালবাসা,সে কী এতই সস্তা যে একটু অভিমানে একেবারে হারিয়ে যাবে।অর্ণব তো পাল্টায় নি।পাল্টেছে আমাদের জীবন।ভালবাসা তো সেই একই আছে।ব্যস্ত সময়গুলো শুধু একটা অভিমানের পর্দা ফেলে দেয় চোখে।আর আমরা গভীরে ভাবতে ভুলে যাই,বাইরেটাই বিশ্বাস করি।নতুন দিনকে,নতুন সুখকে দুজন মিলে ঠিক সাজাব আমাদের জীবনে।রাতে ছাদে গিয়ে জ্যোছনায় ভিজলাম অর্ণবের সাথে।তোমার মনে আছে বিনয় মজুমদারের সেই কবিতাটা,যেটা কলেজের প্রোগ্রামে দুজনে একসাথে করেছিলাম?হ্যাঁ,খুব মনে আছে।আবার দুজনে সেই প্রিয় কবিতা আওড়ালাম," অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে,কাকে বলে নীল-আকাশের হৃদয়ের;কাকে বলে নির্বিকার পাখি।অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রানের উপরে।আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি,দেখি জানালায় আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো,ফিরে এসো , চাকা,রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সব আকাশে। "
No comments:
Post a Comment