Ads 468x60px

Tuesday, November 24, 2015

পৃথিবীর রং মুহূর্তেই বদলায়



শরতের শেষ বিকেলে আলো আঁধারের মাঝে অব্যস্ত অলস ভাবে হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগছে , ব্যস্ততা ছিল তারপরও তড়িঘড়ি করতে ইচ্ছে হোল না , প্রকৃতির প্রতিটি সূক্ষ্ম মুহূর্তকে মর্মে মর্মে অনুভবে আলাদা আনন্দ আছে । এই আনন্দ ভোগের জন্য প্রায়ই অলস ভাবে হেঁটে বেড়াই আমি । রাস্তায় পড়ে থাকা শুঁকনো পাতা গুলোর ক্রাশ ক্রাশ শব্দে অন্য রকম একটি ছন্দ যুক্ত হয়েছে প্রকৃতিতে । থেকে থেকে হিমশীতল উত্তরী বাতাস বইছে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে । শীতের দেশে চারটি ঋতু - গ্রীষ্ম , শরত , শীত আর বসন্ত , মাঝে হেমন্ত আর বর্ষা নেই । শরত আমার ভীষণ প্রিয় - চারপাশে রং এর ছড়াছড়ি , হলুদ লাল সবুজ , প্রকৃতি এ সময়ে এক অসামান্য রূপ ধারণ করে , সবুজ ঘাসের উপর হলদে পাতায় ছেয়ে স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় । প্রকৃতির এই শোভা দেখতে দেখতে ভুলেই যাই নিজেকে , সমস্ত কাজ আর জাগতিক সম্পর্ক গুলোও আবছা হয়ে আসে ।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো - ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে বিরক্তির সুরে শ্যামল বলে উঠলো -
- কি ব্যাপার , তুমি কোথায় কেয়া ? কতক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছি ।
- এইতো প্রায় চলে এসেছি, ট্রাফিকে আটকে ছিলাম অনেক্ষন , আসছি , চিন্তা করো না ।

আজকাল বেশ দক্ষ অভিনেত্রীও হয়ে উঠেছি ,মনের অজান্তেই পরিবেশের সাথে খাপ রেখে গল্প সাজিয়ে তাতে অভিনয়ও করে ফেলি , অতি সহজ ভাষায় বলতে গেলে - তাৎক্ষনিক মিথ্যে কথায় বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছি । এই মাত্র শ্যামলের সাথে যেটা বললাম , আমিতো মোটেই ট্রাফিক জ্যামে ছিলাম না । আসলে সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য কতো কি না করতে হয় । বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রে দক্ষ ভাবে অভিনয় করতে পারলেই জীবন প্রবাহ বোয়ে চলে সার্থক ভাবে । যে'ই এখানে দক্ষ অভিনয় করতে ব্যর্থ ,তারই প্রবাহে গতিবিঘ্ন ঘটে ।

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ইউনিভার্সিটি , তারপর সোজা চলে গেলাম বেজমেন্ট লাইব্রেরিতে । ওখানেই আমাদের স্টাডি রুম বুক করা ছিল । টার্ম টাইমে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে ।

শ্যামল ভীষণ রেগে আছে , আমি একঘণ্টা লেট । আমরা একটা এম্পায়রিকাল রিসার্চ করছি সাউথ এশিয়ান কমিউনিটি তে ডিভোর্স এর হাড় বৃদ্ধির কারণ ও এর সোশাল ইমপ্যাক্টের উপড় । শ্যামল কলকাতার ছেলে , ভীষণ পড়ুয়া এবং ভীষণ পাঞ্চুয়াল । এই রিসার্চটা নিয়ে ও ভীষণ সিরিয়াস , আমিই মাঝে মাঝে অমনোযোগী হয়ে পরি । আমার মনটা বিভিন্ন খানে ছুটে বেড়ায় , মনটাকে একটি জায়গায় বন্দি করাটা ভীষণ দুঃসাধ্য হয়ে পরে কখনো সখনো । শ্যামলকে খুশি করার জন্য বললাম ,

- এই জানো পাঁচ জনকে পেয়ে গেছি , ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছে । তুমি কাউকে পেয়েছ ?
- না , আমার তো আসলে ওরকম পরিচিত কেউ নেই এখানে । তোমার উপর ডিপেন করেই তো আমি এই প্রজেক্টে এসেছি ।
- ঠিক আছে চিন্তা করো না শ্যাম , সব ম্যনেজ হয়ে যাবে ।

শ্যামলের পড়া ছাড়া আর কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই , এমন কি আমি যে এত সুন্দরি একটি মেয়ে বসে আছি ওর সামনে , ওর তাতে কোনই বিকার নেই । কখনো ভালো করে চোখ মেলেও দেখেনি আমাকে । ছেলেরা সাধারণত সুন্দরি মেয়ে দেখলে বোকার মতো আচরণ করতে শুরু করে - আর এটাই তো স্বাভাবিক । কিন্তু এই ছেলেটি একদমই অন্যরকম । এইতো সেদিন তূর্যের অফিসের পার্টিতে নতুন জয়েন করা আইরিশ একটি মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তূর্য , আর ঐ সময়টাতে তূর্য মানে আমার স্বামী ভদ্রলোকটি একেবারেই বোকার মতো আচরণ করছিলো । আমি মনে মনে ভীষণ হাসছিলাম ওর কাণ্ড কীর্তি দেখে । আর শ্যামল একেবারেই অন্য রকম , আসলে , ও একটু অন্যরকম বোলেই একসাথে কাজটা করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না ।

বেশ অনেক্ষন হয়ে গেলো লাইব্রেরিতে , ঘড়ীর দিকে তাকিয়ে দেখি রাত নটা বাজে । ফোন খুলতেই তূর্যের টেক্সট ম্যাসেজটা চোখে পড়লো - ও লিখেছে আজ রাতে ওর বাড়ি ফিরতে দেরি হবে , কাজ শেষে ওরা কোলিকরা সবাই পাবে যাবে আর আজ যেহেতু ফ্রাইডে নাইট কাল আর অফিসের ঝামেলা নেই । আমারও মনে হোল বাসায় না ফিরে কিছুক্ষণ বাইরেই কাঁটিয়ে যাই , শ্যামলকে বললাম,

- শ্যাম , চলো বাইরে কোথাও ঘুরে আসি , মাথাটা কেমন জানি ইনফরমেশনে প্যাক্ট হয়ে আছে , একটু রিলেক্স এর প্রয়োজন ।
- ঠিক আছে চলো যাওয়া যাক ।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে শ্যামল বলল ,
- কেয়া , আমার ডরমিটরি তো একদমই কাছে , তুমি চাইলে আমরা ওখানেও কিছুটা সময় কাঁটাতে পারি । আসলে পাব জায়গাটা এতো কেওটিক যে ওখানে বেশিক্ষণ থাকলে আমার মাথা ধরে যায় ।

- হুম ঠিকই বলেছ , চলো নাহয় তোমার ডরমিটরিতেই যাই ।

ছেলেটা ভীষণ অমায়িক, মাঝে মাঝে আমি বুঝতেই পারি না আমি একটি ছেলের সাথে কথা বলছি নাকি মেয়ের সাথে । হাঁটতে হাঁটতেও ও আমাদের প্রজেক্ট নিয়েই কথা বলছে । আমার পার্সোনাল ব্যাপারেও ওর কোন আগ্রহ নেই আর ওর নিজের ব্যপারেও কখনো কিছু বলেনি । ইউনিভার্সিটি থেকে দশ মিনিটের হাঁটার পথ ওর ডরমিটরিটি । ওখানে পৌঁছে , আমি তো অবাক ! - সুন্দর করে গোছানো , একেবারে টিপটপ পরিপাটী । ছেলেদের ঘরও এতো সুন্দর গোছানো থাকে ! ভাবাই যায় না । শ্যামল আমাকে জিজ্ঞেস করলো ,

- অনেক পুড়নো একটি ব্র্যান্ডি আছে , চলবে তোমার ? নাকি গতানুগতিক ভালো মেয়েদের মতো হোয়াইট ওয়াইনই চাই তোমার ?

আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম , এতো উদাসীন একটি মানুষ কি করে খেয়াল করলো যে আমি হোয়াইট ওয়াইন ছাড়া কিছু খাই না । আমি প্রতিউত্তরে বললাম ,

- ভালো মেয়েরা যা খায় সেটাই দাও ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্যামল ওয়াইন গ্লাসে করে দু গ্লাস ওয়াইন নিয়ে আসলো । এবং স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে শুরু করলো প্রজেক্ট নিয়ে । আমি ওকে থামিয়ে বললাম তুমি তোমার বাড়ির কথা বল , প্রজেক্ট নিয়ে পরে কথা বলা যাবে । ও থেমে গেলো আর আমার দিকে তাকিয়ে ছিল । ইতিমধ্যেই , আমি কয়েক চুমুক ওয়াইন নিয়ে ফেলেছি । হঠাৎ করেই আমি ওর চোখের ভিতর অজানা অন্ধকারচ্ছন্ন রাস্তা দেখতে পেলাম , মনে হোল দমকা ঝোড় হাওয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো । তারপর আর কিছুই মনে নেই ।

চোখ মেলে যখন তাকালাম , তখন নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় দেখতে পেলাম , পাশে তূর্য আমার হাত ধরে বসে আছে । ওকে জিজ্ঞেস করলাম ,

- আমার কি হয়েছে ? আমার সারা শরীরে এতো ব্যাথা কেন ?
- তোমার কিছু হয়নি কেয়া , তুমি ভালো আছো । তুমি বেঁচে আছো ।

তূর্যর চোখে কখনো পানি দেখিনি আমি , ওর গাল বেয়ে পানি ঝরছে , ঠোঁট কাঁপছে । তখনই আমি বুঝতে পারছিলাম কাল রাতে কি কি হয়েছিলো আমার সাথে । আমার চোখে পানি দেখে , ও নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে ওর বুকে টেনে নিলো , আপ্রাণ চেষ্টা করছে আমাকে শারীরিক আর মানসিক ভাবে সারিয়ে তোলার । ও যে আমাকে এতোখানি ভালোবাসে সেটা আমি আগে এতোটা গভীরভাবে উপলব্ধি করিনি কখনো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো ,

- তূর্য আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি , অনেক অনেক ।
কিন্তু গলা দিয়ে একটি শব্দ বের হোল না । কখনো এই কথাগুলো মুখে বলিনি আমি , আজও বলতে পারিনি । চোখে চোখে বলেছি অনেক বার কিন্তু এই অতি আবেগি অনুভূতিকে প্রকাশ করার সুযোগ্য কোন শব্দ পাইনি কখনো । একমাত্র এই জায়গা গুলোতে আমি দক্ষ অভিনেত্রীর কাজটি সম্পন্ন করতে পারিনি কখনোই ।

আমাদের পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে আমরা বেশিভাগ সময়ই ব্যস্ততায় কাটিয়েছি , যার যার ক্যারিয়ার আর স্টাডিজ নিয়ে । মা হওয়ার সময়টুকুও বের করতে পারিনি এই পাঁচ বছরে । আজ , এতো এতো পড়াশুনা পিএইচডি সব কিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে , মনে হচ্ছে অযথাই এতো কিছু করা । জীবনটা কেমন যেন সাদামাটা হয়ে গেছে , প্রকৃতির রং গুলো এখন আর ওভাবে উপলব্ধি করতে পারি না । বেশিভাগ সময়ই ঘড় অন্ধকার করে বসে থাকি বিমর্ষ হয়ে ...

No comments:

Post a Comment

 

Sample text

Sample Text

Sample Text

 
Blogger Templates